আওয়ামী লীগ সরকারসমূহের গৌরবোজ্জ্বল সাফল্য

img

সম্পাদকীয়:

 পূর্ব বাংলায় প্রথম আওয়ামী লীগ সরকার ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৫৬ যখন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগ সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নেয় তখন চরম খাদ্যাভাব ছিল। সেই দুর্ভিক্ষ অবস্থা অত্যন্ত সাফল্যের সাথে সরকার মোকাবিলা করে। কোটি কোটি নিরন্ন মানুষকে অনাহার থেকে রক্ষা করে। প্রদেশের আর্থ-সামাজিক সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে বেশ কিছু কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়িত করে। বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য ক্রুগ মিশন গঠন এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
আওয়ামী লীগের উদ্যোগেই মাতৃভাষা বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষার আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্রীয় মর্যাদা লাভ করে। ২১ ফেব্রুয়ারি ঘোষিত হয় জাতীয় ছুটির দিন ‘শহীদ দিবস’। আওয়ামী লীগ সরকারের উদ্যোগেই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ১৯৫৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও বাংলা একাডেমির আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয় আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়েই এফডিসি, জুট মার্কেটিং কর্পোরেশন, ওয়াপদা গঠন, ফেঞ্চুগঞ্জে প্রথম সার কারখানা নির্মাণ, সাভার ডেইরি ফার্মের সূচনা, স্থায়ী শিল্প ট্রাইব্যুনাল গঠন এবং সরকারি, আধা-সরকারি বেশ কিছু স্বায়ত্তশাসিত/আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। আওয়ামী লীগ সরকার দেশের প্রথম প্ল্যানিং কমিশন গঠন, শিক্ষা সংস্কার কমিটি গঠন, প্রথম লেবার রেজিস্ট্রেশন আইন পাস, ঢাকা-আরিচা জাতীয় সড়ক নির্মাণ, কক্সবাজারে প্রথম পর্যটন কেন্দ্র নির্মাণ, কৃষি ঋণের সার্টিফিকেট প্রথা বাতিল, রমনা পার্ক স্থাপন, উচ্চফলনশীল ধান উদ্ভাবন, পাওয়ার পাম্পে সেচ ব্যবস্থা চালু এবং ময়মনসিংহে দেশের প্রথম পশু চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন করে। সেই সময় একটি 25স্থায়ী আমদানি-রপ্তানি কন্ট্রোলারের অফিস স্থাপিত হয়। গঠিত হয় রাজধানী ঢাকা ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামের উন্নয়নের জন্য যথাক্রমে ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট, চিটাগাং ডেভলপমেন্ট অথরিটি ও কেডিএ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই সরকারের মন্ত্রী হিসেবে রাজশাহী, রংপুর ও খুলনায় বেতার কেন্দ্র স্থাপন এবং বেতারের সংবাদ সম্প্রচারের ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। কেন্দ্রের অসহযোগিতা সত্ত্বেও প্রদেশে আওয়ামী লীগ সরকার ভৌত-অবকাঠামো উন্নয়ন, শিল্পের প্রসার এবং কৃষি ও সমবায়সহ গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে নিরন্তর প্রয়াস চালিয়ে দেশের মানুষের আস্থা ও ভালোবাসা অর্জন করে।

বাংলাদেশের প্রথম সরকার-মুজিবনগর সরকার
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে পাক-হানাদার বাহিনীর মোকাবিলায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে জনগণকে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করার নির্দেশ দেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ১০ এপ্রিল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তাকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করে উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন। প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন তাজউদ্দিন আহমদ। মন্ত্রিসভায় আরও ছিলেন ক্যাপ্টেন (অব.) মনসুর আলী, এএইচএম কামারুজ্জামান ও খন্দকার মোশতাক আহমেদ। সরকার শপথ গ্রহণ করেন ১৭ এপ্রিল।
আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্য (এমএনএ) কর্নেল (পরে জেনারেল) এমএজি ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর প্রধান নিযুক্ত করা হয়। প্রবাসী সরকার লক্ষাধিক মুক্তিযোদ্ধার সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। ১১টি রণাঙ্গনে ভাগ করে সাফল্যের সাথে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে। সেই সাথে দলীয় সংসদ সদস্যদের মাধ্যমে যুবশিবির সংগঠিত করে ও জনগণের মনোবল অক্ষুণœ রাখার ব্যাপারে সহায়তা করে। মুক্ত অঞ্চলে বেসামরিক প্রশাসন পরিচালনাও ছিল মুজিবনগর সরকারের অন্যতম কৃতিত্ব।
মুজিবনগর আওয়ামী লীগ সরকার বেসামরিক সচিবালয় স্থাপন করে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র স্থাপন করে দেশের ভেতরে ও বাইরে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে লাগাতার প্রচার চালিয়ে যায়। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জনমত গঠনের জন্য বহির্বিশ্বে ব্যাপক প্রচারণারও সফল আয়োজন করা হয়। চলচ্চিত্র নির্মাণ, পুস্তিকা প্রকাশ এবং পোস্টার ও হ্যান্ডবিল-লিফলেট বিলি, সংবাদপত্র প্রকাশ ইত্যাদি কর্মকা- জোরেশোরে পরিচালিত হয়। জাতিসংঘে ও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রতিনিধি প্রেরিত হয়। যেসব কূটনীতিক বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ও আস্থা প্রকাশ করেন তাদেরও কর্মপরিধি পরিচালিত হয় মুজিবনগর সরকারের নির্দেশে। শরণার্থীদের ত্রাণ তৎপরতায়ও মুজিবনগর সরকার অত্যন্ত তৎপরতার পরিচয় দেয়।

বঙ্গবন্ধু সরকারের সাফল্য
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন সরকার তাদের অর্থনৈতিক কর্মকা- পরিচালিত করেছিলেন, দুটি ভাগেÑ প্রথমত; পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন এবং দ্বিতীয়ত; উন্নয়ন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বপ্ন দেখতেন সুখী, সমৃদ্ধ, বৈষম্যহীন বাংলাদেশের। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্য ও বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়-অর্জনের পর বঙ্গবন্ধু শুরু করেন দ্বিতীয় বিপ্লব ‘অর্থনৈতিক মুক্তি’র সংগ্রাম। ৩ কোটি ছিন্নমূল মানুষ, দেড় কোটি অগ্নিদগ্ধ ঘরবাড়ি, ১ কোটি শরণার্থীর প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন সমস্যা, শূন্য খাদ্য গুদাম, অনাবাদি জমি, অচল বন্দর, ডুবন্ত নৌযান, যোগাযোগ পরিবহন এবং অভ্যন্তরীণ নৌ ও সমুদ্র বন্দরের অচলাবস্থা, ধ্বংসপ্রাপ্ত অবকাঠামো, মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধজনিত কারণে তেলের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি, স্বাধীনতা-বিরোধীদের অন্তর্ঘাত ও নাশকতামূলক তৎপরতায় বিপর্যস্ত জনজীবন এমন চরম বিরূপ ও সংকটাকুল পরিস্থিতি মোকাবিলা এবং সকল প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে জাতিসংঘের স্বীকৃতি অর্জনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন সরকার যে সফলতা দেখিয়ে বিশ্বের ইতিহাসে তা বিরাল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
তখন বিভিন্ন দেশ ও সাহায্য সংস্থা যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থা জরিপ করে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল যে, যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে খাদ্যাভাবে ২ কোটি লোক মৃত্যুবরণ করবে। বঙ্গবন্ধুর সরকার দেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে ৪ কোটি ৭৫ লাখ মণ খাদ্যসামগ্রী বিনামূল্যে ও স্বল্পমূল্যে বিতরণ করে অবশ্যম্ভাবী মৃত্যু ঠেকাতে সমর্থ হয়েছিলেন; বঙ্গবন্ধুর সময়োচিত পদক্ষেপে এই ভয়াবহ সংকট মোকাবিলা বিশ্ববাসীকে অভিভূত করেছিল। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও ভৈরব সেতুসহ ৫৬৭টি সেতু নির্মাণ ও মেরামত, ৭টি নতুন ফেরি, ১ হাজার ৮৫১টি রেলওয়ে ওয়াগন ও যাত্রীবাহী বগী, ৪৬টি বাস, ৬০৫টি নৌযান ও ৩টি পুরাতন বিমান চালু করে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং মাইন উদ্ধার করে অচল বন্দরসমূহ সচল করা হয়। সম্পূর্ণরূপে দেউলিয়া ও প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত পাকিস্তানিদের পরিত্যক্ত ব্যাংক, বীমা ও ৫৮০টি শিল্প ইউনিট জাতীয়করণ ও উৎপাদনক্ষম করে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক-কর্মচারীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা এবং ঘোড়াশাল সার কারখানা, আশুগঞ্জ কমপ্লেক্সের প্রাথমিক কাজ ও অন্যান্য নতুন নতুন শিল্প কল-কারখানা গড়ে তোলার ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ‘জনগণ সকল ক্ষমতার উৎস’ ঘোষণা করে মাত্র ৯ মাসের মধ্যে একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। বিশ্বের ইতিহাসে যা একটি বিরল দৃষ্টান্ত।
তিন মাসের মধ্যে ভারতীয় সৈন্যদের ফেরত পাঠানো, পাকিস্তানে আটক প্রায় ৪ লাখ বাঙালিকে দেশে ফিরিয়ে এনে পুনর্বাসিত করা, ৭ লাখ পাকিস্তানিকে ফেরত পাঠানো, মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ফিরিয়ে নেওয়া, মুক্তিযুদ্ধে নিহত শহীদ পরিবারকে আর্থিক সাহায্য ও ২ লাখ নির্যাতিত মা-বোনের দায়িত্ব গ্রহণ, চিকিৎসার জন্য পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের বিদেশ প্রেরণ, মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট ও নারী পুনর্বাসন বোর্ড গঠন, প্রতি থানা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় ও হাসপাতাল নির্মাণ, ১১ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন, ৫৪ হাজার শিক্ষক নিয়োগসহ স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা নির্মাণ, সেনা, বিমান ও নৌবাহিনীসহ প্রতিরক্ষা বাহিনীকে জাতীয় মর্যাদায় পুনর্গঠন, সামরিক একাডেমি স্থাপন, পুলিশ, বিডিআর, আনসার ও বেসামরিক প্রশাসনের অবকাঠামো গড়ে তোলা, প্রতিবেশী দেশের সাথে সীমান্ত ও ফারাক্কার পানি চুক্তি, জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ ও ১৪০টি দেশের স্বীকৃতি লাভের ন্যায় কারিসম্যাটিক সফলতা অর্জন, বাংলার জনগণের প্রতি বঙ্গবন্ধুর অকৃত্রিম ভালোবাসা ও অপরিসীম ত্যাগের মানসিকতার ফলে সম্ভব হয়েছিল। মাত্র সাড়ে তিন বছরে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন সরকার রক্ত¯œাত ধ্বংসস্তূপের মধ্যে শূন্য হাতে একটি সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে যে সফলতা অর্জন করেছিল তা বিস্ময়কর ব্যাপার।
বিশ্বব্যাংকের হিসাব মতে, ১৯৭২-৭৫ সালে বাংলাদেশের জাতীয় আয় বৃদ্ধির বার্ষিক হার ছিল গড়ে ৫ শতাংশ। বাংলাদেশ সরকারের পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে এ সময়ে আয় বৃদ্ধির বার্ষিক হার ছিল ৭ শতাংশ। মদ, জুয়া, হাউজি, ঘোড়দৌড়সহ সব ইসলামবিরোধী কর্মকা- কার্যকরভাবে নিষিদ্ধকরণ, ইসলামী ফাউন্ডেশন গঠন ও মাদ্রাসা বোর্ড প্রতিষ্ঠা, পবিত্র হজব্রত পালনে সরকারি অনুদান প্রদান, ইসলামি সম্মেলন সংস্থার সদস্যপদ লাভ ইত্যাদি ছিল উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। শান্তির স্বপক্ষে বলিষ্ঠ ও দৃঢ় পদক্ষেপ কার্যকর করার অভিযাত্রায় বিশ্ব শান্তি পরিষদ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সর্বোচ্চ খেতাব ‘জুলিও কুরি’ পদকে ভূষিত করে সারাদেশবাসীকে মহিমান্বিত করেছিল।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে স্বাধীনতা-প্রগতি-মানবতাবিরোধী ও প্রতিক্রিয়াশীল ঘাতকচক্র রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে এবং মার্শাল ল’ জারি করে।

জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ
সরকারের সাফল্য (১৯৯৬-২০০১)

সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করা সত্ত্বেও উন্নয়ন, অগ্রগতি, স্থিতিশীলতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার বৃহত্তর লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্যের সরকার প্রতিষ্ঠা। জাতীয় পার্টি, জাসদ (রব) এবং পরবর্তীতে বিএনপির দুই সদস্যের মন্ত্রিসভায় যোগদান। কেবল বাংলাদেশই নয়, উপমহাদেশের ইতিহাসে জাতীয় ঐকমত্যের সরকারের নজির এই প্রথম।
বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের মতো নির্দলীয় ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করে জাতীয় ঐক্যের পথে আরও একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন। সংসদকে অধিকতর কার্যকর করে তোলার লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ। সংসদীয় স্থায়ী কমিটির প্রধান পদে মন্ত্রীর বদলে সংসদ সদস্যদের (বিরোধী দলেরসহ) নিয়োগ দান। রুলস অব বিজনেস প্রণয়ন করে মন্ত্রণালয়ে জনপ্রতিনিধি ও সরকারি কর্মকর্তাদের এখতিয়ার সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়।
কুখ্যাত কালো আইন ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স বাতিলের মাধ্যমে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করা এবং আমাদের সংবিধানের পবিত্রতা পুনরুদ্ধার। দীর্ঘ ২৩ বছর পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবারের সদস্যদের বর্বরোচিত হত্যাকা-ের বিচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করা হয়।
আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণের মাত্র ছয় মাসের মধ্যে, ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর ভারতের সাথে গঙ্গা নদীর পানি বণ্টনে ৩০ বছর মেয়াদি চুক্তি সম্পাদন করতে সক্ষম হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে দীর্ঘ দুই দশক ধরে বিরাজ করছিল হানাহানি ও সংঘাত। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর জননেত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে শান্তি বাহিনীর নেতা সন্তু লারমা শান্তিচুক্তিতে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাক্ষরের মাধ্যমে সংঘাতের অবসান ঘোষণা করেন। ১৯৯৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ির স্টেডিয়ামে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে ‘শান্তিবাহিনী’ প্রধান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা আনুষ্ঠানিকভাবে অস্ত্র সমর্পণ করেন। সেই সাথে ওই বাহিনীর প্রায় ২ হাজার সশস্ত্র সদস্যও গোপন অবস্থান থেকে বেরিয়ে এসে অস্ত্র সমর্পণ করে ফিরে যান স্বাভাবিক জীবনে। একই সময়ে ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী প্রায় ৬৫ হাজার চাকমা শরণার্থী মাতৃভূমিতে ফিরে আসেন।
১৯৯৭ সালের উপকূলীয় ঘূর্ণিঝড়, ১৯৯৮ সালের শতাব্দীর প্রলয়ঙ্করী বন্যা এবং ২০০০ সালে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১১টি জেলায় ৫০ বছরের মধ্যে প্রথম আকস্মিক ভয়াবহ বন্যা মোকাবিলায় আওয়ামী লীগ সরকারের অভূতপূর্ব সাফল্য দেশবাসী ও বিশ্ব সম্প্রদায়ের বিপুল প্রশংসা অর্জন করে। ১৯৯৮ সালে দেশের ৫৩টি জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বিধ্বংসী বন্যায় ২ কোটি মানুষ না খেয়ে মারা যাবে বলে বিরোধী দল যে প্রচার করেছিল, তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়। একজন মানুষও খাদ্যের অভাবে মারা যায়নি।
শেখ হাসিনার সরকারের আমলেই দেশ সর্বপ্রথম খাদ্যে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করেছে। নির্দিষ্ট সময়ের দুই বছর আগেই খাদ্যে বিএনপি আমলের ৪০ লাখ টন ঘাটতি পূরণ করে স্বয়ম্ভরতা অর্জন এবং ২ কোটি ৭০ লাখ মেট্রিক টনের রেকর্ড পরিমাণ খাদ্য উৎপাদন আওয়ামী লীগ সরকারের একটি যুগান্তকারী সাফল্য। ২৫ লাখ মেট্রিক টন উদ্বৃত্ত খাদ্য উৎপাদন করে আওয়ামী লীগ সরকার দেশবাসীর জন্য গড়ে তুলেছে একটি নির্ভরযোগ্য খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিকাশে আন্তরিক ও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ। দীর্ঘ ২১ বছরের ইতিহাস বিকৃতির অবসান। নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধ ও দেশের প্রকৃত ইতিহাস সম্পর্কে জ্ঞানদানের উদ্যোগ গ্রহণ। অবহেলিত মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে তাদের সন্তানদের জন্য চাকরি ও শিক্ষাক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ, অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক ৩০০ টাকা হারে সম্মানী-ভাতা প্রদান, মৃত্যুর পর মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন বা সৎকার এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শিখা চিরন্তন স্থাপন ও স্বাধীনতার বিজয়স্তম্ভ নির্মাণসহ মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন স্মৃতি সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরলস প্রচেষ্টায় ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বরে ইউনেস্কোর ৩০তম সাধারণ সম্মেলনে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে বাঙালি জাতির গর্ব ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রদান করে।
নারীর অধিকার, মর্যাদা ও ক্ষমতায়নে আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৭ সালের ৮ মার্চ নারী উন্নয়ন নীতিমালা ঘোষণা করে। ব্যবস্থা করা হয় ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভাসহ স্থানীয় সরকারে মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচনের।
২১ বছরের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে আওয়ামী লীগ পাঁচ বছরের শাসনামলে গড়ে সর্বোচ্চ প্রায় ৬ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করে। মাথাপিছু আয় ২৮০ মার্কিন ডলার থেকে বেড়ে ৩৮৬ মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী জনসংখ্যার হার কমে আসে। অনুচ্চ দারিদ্র্য সূচক বিএনপি আমলের ৪৭.২ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৩৪ শতাংশ। গড় আয়ু ৫৮.৭ থেকে ৬১.৮ বছরে উন্নীত হয়।
শিল্প-বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। স্থাপিত হয় ১ লাখ ৬ হাজার ৭৭৭টি ছোট-বড় শিল্প-কারখানা। এতে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে।
বিশ্বের ১১তম বৃহত্তম দীর্ঘ সেতু বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতুর নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়। নির্মিত হয় ধলেশ্বরী ১ ও ২ নম্বর সেতু, পঞ্চগড়ে করতোয়া সেতু ও বুড়িগঙ্গা দ্বিতীয় সেতুসহ অসংখ্য ছোট-বড় সেতু। এ ছাড়া রূপসা ব্রিজ, পাকশীতে এম মনসুর আলী সেতু ও ভৈরবের কাছে মেঘনা নদীতে সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেতু, কুড়িগ্রামে ধরলা সেতু, বরিশালে দোয়ারিক-শিকারপুর সেতুসহ আরও বড় বড় সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। নির্মিত হয়েছে মাঝারি ও ছোট-বড় অসংখ্য সেতু। পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। জাপানি সহায়তায় শুরু হয়েছিল সমীক্ষার কাজ।
আওয়ামী লীগের পাঁচ বছরের শাসনামলে নতুন ১৫ হাজার ৯২৮ কিলোমিটার পাকা রাস্তা, ৩৫ হাজার ৮০২ কিলোমিটার কাঁচা রাস্তা ও ১৯ হাজার পুল ও কালভার্ট এবং ২ হাজার ৪০১ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করা হয়।
বিদ্যুৎ উৎপাদন বিএনপি আমলের ১৬০০ মেগাওয়াট থেকে বেড়ে দ্বিগুণেরও বেশি অর্থাৎ, ৩৮০৩ মেগাওয়াট উন্নীত হয়। গ্যাস উত্তোলন বিএনপি আমলের ৭০ কোটি থেকে বেড়ে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ১৩০ কোটি ঘনফুট ছাড়িয়ে যায়।
টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সরকার এক বিপ্লবের সূচনা করে। মোবাইল ফোনের দাম ১ লাখ থেকে ৫-৬ হাজার টাকায় নামিয়ে আনা হয়। ফলে মোবাইল টেলিফোন গ্রাহকের সংখ্যা বিএনপি আমলের ২১ হাজার থেকে বেড়ে আড়াই লাখ ছাড়িয়ে যায়। কম্পিউটার আমদানির ওপর থেকে শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়।
একটি গণমুখী শিক্ষানীতি প্রণীত হয়। শিক্ষা খাতে দেওয়া হয় সর্বোচ্চ বাজেট বরাদ্দ। সাক্ষরতার হার বিএনপি আমলের ৪৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ৬৫ শতাংশে দাঁড়ায়। দেশে এই প্রথম একটি চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয়, দুটি নতুন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, দুটি নতুন সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়, একটি মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়, ৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিপুল সংখ্যক নতুন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজ ও মাদ্রাসা স্থাপন করা হয়। উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগই প্রথম দেশে ১২টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়।
স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে দেশে প্রথম জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি প্রণীত হয়। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য প্রতি ৬ হাজার মানুষের জন্য একটি করে ১৮ হাজার প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র নির্মাণ করার কাজ হাতে নেওয়া হয়। এর মধ্যে ১০ হাজার প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়। দেশের হাসপাতালের শয্যাসংখ্যা আগের চেয়ে ৭ হাজার বৃদ্ধি করা হয়। প্রতিষ্ঠা করা হয় কিডনি, ক্যানসার ও নিউরোলজিসহ বেশ কয়েকটি বিশেষায়িত হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট।
দারিদ্র্য বিমোচন ও দুখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর লক্ষ্যে শেখ হাসিনার সরকার দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহের মধ্যে সর্বপ্রথম বয়োজ্যেষ্ঠ সমসংখ্যক (প্রতি ইউনিয়নে ৯০ জন) দুস্থ মহিলা ও পুরুষের জন্য মাসিক ‘বয়স্ক ভাতা’ এবং বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা মহিলা ভাতা স্কিম চালু করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত উদ্যোগে ছিন্নমূল মানুষদের আবাস ও কর্মসংস্থানের জন্য গৃহীত আশ্রয়ণ প্রকল্পে এ পর্যন্ত ৩৩ হাজার পরিবারের ২ লাখ মানুষ পুনর্বাসিত হয়। ‘আদর্শ গ্রামে’ পুনর্বাসিত করা হয়েছে ৪৫ হাজার ছিন্নমূল পরিবারকে। এ ছাড়া বস্তিবাসীদের গ্রামে পুনর্বাসনের জন্য ‘ঘরে ফেরা’ কর্মসূচি, অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের থাকার জন্য ‘শান্তি নিবাস’ এবং গৃহায়ন তহবিল থেকে দেশের ইতিহাসে এই প্রথম গ্রামীণ দরিদ্রদের জন্য গৃহ নির্মাণ ঋণদান কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। এ ছাড়া দারিদ্র্য নিরসন ও প্রতিটি বাড়িকে স্বয়ম্ভর অর্থনৈতিক ইউনিটে পরিণত করার লক্ষ্যে জননেত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত উদ্যোগে গ্রহণ করা হয় ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্প।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই প্রথম বন্যা-ঝড়-জলোচ্ছ্বাস প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়, প্রতিবছর ফসল ওঠার আগে এবং প্রতি ঈদ ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের উৎসবের সময় লাখ লাখ দরিদ্র পরিবারকে ভিজিএফ কার্ডের মাধ্যমে বিনামূল্যে খাদ্য সাহায্য দেওয়া হয়।
শ্রমিক-কর্মচারীদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য জাতীয় মজুরি ও উৎপাদনশীলতা কমিশন কর্তৃক প্রণীত শ্রমিকদের নি¤œতম মজুরির সুপারিশ বাস্তবায়িত করা হয়। নির্বাচনী ওয়াদা অনুযায়ী একটি গণতান্ত্রিক ‘শ্রমনীতি’ প্রণয়ন করা হয়। ১১টি রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প-কারখানার মালিকানা ও পরিচালনার দায়িত্বভার সংশ্লিষ্ট শিল্পের শ্রমিক-কর্মচারীর কাছে হস্তান্তর করা হয়। এই প্রথম মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের জন্য একটি স্বতন্ত্র ‘কল্যাণ ট্রাস্ট’ গঠন করা হয়েছে।
মাতৃভাষার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ভাষায় পারদর্শিতা অর্জনে ২০০১ সালের মার্চে ঢাকায় স্থাপিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট। শিল্পী-সাহিত্যিকদের কল্যাণে গঠন করা হয় শিল্পী কল্যাণ ট্রাস্ট।
বাংলাদেশ ক্রিকেট টেস্ট মর্যাদা লাভ করে। সার্ক ফুটবলে সোনা জয়সহ অন্যান্য খেলাধুলার ক্ষেত্রেও সাধিত হয়েছে আশাপ্রদ অগ্রগতি।
দেশের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে বিগত নির্বাচনে দেওয়া আওয়ামী লীগের অঙ্গীকার ও কর্মসূচি দেশকে বিশ্বসভায় অধিষ্ঠিত করে এক গৌরবের আসনে। প্রতিবেশী ভারতের সাথে গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি সম্পাদন, দুটি দেশের মধ্যে সরাসরি বাস সার্ভিস ও ট্রেন যোগাযোগ চালুসহ অন্যান্য অমীমাংসিত সমস্যার সমাধানে অর্জিত হয়। সার্কভুক্ত অন্যান্য প্রতিবেশী দেশ এবং মিয়ানমারের সাথে সৎ প্রতিবেশীসুলভ বহুমুখী সহযোগিতার ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের উদ্যোগে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ত্রি-দেশীয় বাণিজ্যিক শীর্ষ সম্মেলন, ডি-৮ শীর্ষ সম্মেলন এবং এশিয়ান পার্লামেন্টারিয়ান সংসদের প্রথম সম্মেলন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ইউনেস্কো শান্তি পুরস্কার ও জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ফাও-এর সেরেস পদক লাভ এবং ২০০০ সালের এশিয়ার শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্বের স্বীকৃতি অর্জন করেন।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের
দ্বিতীয় দফার ৫ বছর (২০০৯-১৩)

বাংলাদেশের ইতিহাসে আওয়ামী লীগই দেশের উন্নয়নে একটি দীর্ঘমেয়াদি সুস্পষ্ট কর্মসূচি গ্রহণ করে। ২০০৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত রূপকল্প-২০২১ বা ভিশন উপস্থাপন করে। ২০০৯-১৪ পাঁচ বছর মেয়াদে এই কর্মসূচি ও রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়নের অগ্রগতির সংক্ষিপ্তসার তুলে ধরা হলোÑ
বিশ্বমন্দার প্রভাব সাফল্যের সাথে মোকাবিলা করে বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখার পাশাপাশি বাংলাদেশে গড়ে ৬.২ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়। সামষ্টিক অর্থনীতির এই চিত্র আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসাসূচক স্বীকৃতি অর্জন করে। এই পাঁচ বছরে জাতীয় বাজেটের আয়তন ২০০৬-এর তুলনায় ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৩.৭ গুণেরও বেশি বৃদ্ধি পায়। রেমিট্যান্স বেড়েছে ৩.৭ গুণ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫ গুণ, রপ্তানি আয় বাড়ে আড়াই গুণ। মূল্যস্ফীতির হার ১১ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৭.৫ শতাংশে স্থিতিশীল করা হয়। এ সময়ে জনগণের আয়-রোজগার ও ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
বিএনপি-জামাত জোট সরকারের আমলের পাঁচ বছরই বাংলাদেশ শীর্ষ দুর্নীতিপরায়ণ দেশ হিসেবে কুখ্যাতি অর্জন করেছিল। আওয়ামী লীগের পাঁচ বছরে দুর্নীতি ও অনিয়মের উৎসমুখগুলো বন্ধ করার লক্ষ্যে অনলাইনে টেন্ডারসহ বিভিন্ন সেবা খাতে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে দুর্নীতি কমিয়ে সেই দুর্নাম মোচনে সক্ষম হয়।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে অর্জিত হয়েছে অভূতপূর্ব সাফল্য। ২০১৩ সালের মধ্যে ৭০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করে তা ১০০০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়। ভারত থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হয়। ২০২১ সালের মধ্যে ২৪০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে রাশিয়ার সাহায্যে ২০০০ মেগাওয়াটের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজ শুরু হয়। রামপাল ও চট্টগ্রামে কয়লাভিত্তিক আরও দুটি বৃহৎ বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণকাজ শুরু হয়। এ সময়ে দেশের ৬২ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আসে। নতুন নতুন গ্যাসকূপ খনন, গ্যাসক্ষেত্র এবং দুটি তেলক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়। শিল্প-কারখানা এবং গৃহস্থালী কাজে নতুন গ্যাস সংযোগ দেওয়া হয়।
দারিদ্র্য বিমোচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের অভূতপূর্ব সাফল্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করেছে। দারিদ্র্য বিমোচনসহ কয়েকটি ক্ষেত্রে জাতিসংঘের সহ¯্রাব্দ লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) নির্ধারিত ২০১৫ সালের দুই বছর আগেই অর্থাৎ, ২০১৩ সালে বাংলাদেশ অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। ২০১৩ সালে সাধারণ দারিদ্র্যসীমা ২৬.২ শতাংশে এবং হতদরিদ্রের হার নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ১১.৯ শতাংশে নেমে আসে এবং ৫ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার ওপরে মধ্যবিত্তের স্তরে উঠে এসেছে। পাঁচ বছরে সরকারি ও বেসরকারি খাতে ১ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হয় (দেশের ভেতরে ৬৯ লাখ মানুষের এবং বিদেশে ২৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।) সৌদি আরবে ‘ইকামা’ পরিবর্তনের সুবাদে ৪ লক্ষাধিক কর্মী বৈধ হয়েছে। বেকার যুবকদের আত্মকর্মসংস্থান ও ঋণ প্রদানের লক্ষ্যে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি অব্যাহত আছে। ন্যাশনাল সার্ভিসের আওতায় প্রায় ৫৭ হাজার প্রশিক্ষণার্থী তরুণের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। এই কর্মসূচি অব্যাহত রয়েছে।
নির্বাচনী ইশতেহার-২০০৮-এ সুশাসন প্রতিষ্ঠা ছিল অন্যতম অগ্রাধিকারের বিষয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, শুরুতেই আওয়ামী লীগ সরকারকে মোকাবিলা করতে হয় অকল্পনীয় চ্যালেঞ্জ। জননেত্রী শেখ হাসিনা সরকারের দায়িত্বভার গ্রহণ করার মাত্র ৫২ দিনের মাথায় সংঘটিত হয় রক্তাক্ত বিডিআর বিদ্রোহ। চরম ধৈর্য, অসীম সাহস ও রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিডিআর বিদ্রোহের শান্তিপূর্ণ সমাধান করেন। সেনাবাহিনীতে আস্থা ফিরিয়ে আনেন। ইতোমধ্যে বিডিআর বিদ্রোহের ১৮ হাজার আসামির বিচার সম্পন্ন হয়েছে। এ ছাড়া ফৌজদারি কার্যবিধিতে ৮৫০ অভিযুক্তের বিচার করা হয়েছে। এই বিচার সেনাবাহিনী ও আধা-সামরিক বাহিনীতে শৃঙ্খলা ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়। বিডিআর-এর নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি) রাখা হয়েছে। নতুন আইনও প্রণয়ন করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের বিচারের রায় কার্যকর করা হয়েছে, সম্পন্ন হয়েছে জেলহত্যার বিচার। উন্মুক্ত হয়েছে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পথ। নির্বাচনী অঙ্গীকার অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করে এই মেয়াদে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ১০ যুদ্ধাপরাধীর বিচার সম্পন্ন করে কার্যকর করা হয় কাদের মোল্লার ফাঁসির রায়।
সংসদকে কার্যকর ও অংশগ্রহণমূলক করতে সংসদের প্রথম অধিবেশনেই ৫০টি স্থায়ী কমিটি গঠন করা হয়। বিরোধী দল থেকেও সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা হয়।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান সামরিক ফরমান বলে ’৭২-এর সংবিধান সংশোধন করেন। পরবর্তীকালে সেনাশাসক এরশাদও একইভাবে সংবিধান সংশোধন করেন। ২০০৬ সালে হাইকোর্ট এবং ২০১১ সালে সুপ্রিমকোর্ট জিয়া-এরশাদের সামরিক শাসন ও সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ প্রথম থেকেই সামরিক শাসকদের অবৈধ সংবিধান সংশোধনীর বিরোধিতা করেছে। ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে আওয়ামী লীগ ছিল প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ২০১০ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষ থেকে ’৭২-এর সংবিধানের মূল চেতনায় ফিরে যাওয়ার লক্ষ্যে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বিল সংসদে উত্থাপন করা হয়। ২১ জুলাই ২০১০ জাতীয় সংসদের সব দলের সদস্য সমন্বয়ে ১৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি সংবিধান সংশোধনী সংসদীয় কমিটি গঠিত হয়। দীর্ঘ প্রায় এক বছর সংসদীয় কমিটি দেশের প্রতিষ্ঠিত প্রায় সকল রাজনৈতিক দল, সংবিধান বিশেষজ্ঞ, আইনজীবী, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, পেশাজীবী, সুশীল সমাজের বিভিন্ন সংগঠন এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সাথে আলোচনা ও মতবিনিময় করে। অসংখ্য সংগঠন/প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি লিখিতভাবেও তাদের মতামত জানায়। সংসদীয় কমিটির ২৭টি সভায় এসব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। ৩০ জুন ২০১১ জাতীয় সংসদে পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধনী বিল পাস হয়। এই সংশোধনীর ফলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সম্বলিত ’৭২-এর সংবিধানের চার মূলনীতি সংবিধানে পুনঃসংযোজিত হয়। অসাংবিধানিক পন্থায় ক্ষমতা দখলের পথ রুদ্ধ হয়।
নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে পৃথক এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও আর্থিক ক্ষমতা নিশ্চিত করা হয়েছে। বিচার বিভাগের জন্য প্রবর্তন করা হয়েছে স্বতন্ত্র বেতন স্কেল।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এবারই প্রথম মহামান্য রাষ্ট্রপতি সব রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনার ভিত্তিতে সার্চ কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন গঠন করেন। নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে লোকবল নিয়োগ ও আর্থিক ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনকে দেওয়া হয়েছে। ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা হয়েছে। পাঁচ বছরে সংসদ উপনির্বাচন, সিটি কর্পোরেশন ও মেয়র নির্বাচনসহ ৫ হাজার ৮০৩টি স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে ৬৪ হাজার ২৩ জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হন। স্থানীয় সরকার এবং জাতীয় সংসদের উপনির্বাচনসমূহে নিশ্চিত করা হয়েছে জনগণের ভোটাধিকার। প্রমাণিত হয় আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অবাধ নিরপেক্ষ সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন সম্ভব।
মানবাধিকার নিশ্চিত করতে গঠন করা হয়েছে কার্যকর স্বাধীন মানবাধিকার কমিশন। সংবিধানে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সম-অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। বৈষম্যমূলক অর্পিত সম্পত্তি আইন সংশোধন করা হয়েছে। প্রণয়ন করা হয়েছে তথ্য অধিকার আইন এবং গঠন করা হয়েছে তথ্য অধিকার কমিশন।
আওয়ামী লীগ সরকারের পাঁচ বছর জঙ্গিবাদীদের কঠোর হস্তে দমন করা হয়েছে। সন্ত্রাসী রাষ্ট্রের কলঙ্ক তিলক মোচন করে বাংলাদেশ এখন দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ জনপদ। প্রবাসী বাঙালিদের জাতি গঠন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের নিমিত্তে ৩টি অনাবাসী ব্যাংক স্থাপিত হয়।
সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবসর গ্রহণের বয়স দুই বছর বাড়িয়ে ৫৯ করা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবসর গ্রহণের বয়স বাড়িয়ে করা হয়েছে ৬০ বছর। ঘোষণা করা হয়েছে ২০ শতাংশ মহার্ঘ্য ভাতা। সরকারি চাকরিতে নিযুক্ত মহিলাদের মাতৃত্বকালীন ছুটি চার মাস থেকে বাড়িয়ে ছয় মাসে উন্নীত করা হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন কমিশন গঠন করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার রাজস্ব খাতে ৪ লাখ ২৭ হাজারের বেশি পদ সৃষ্টি করেছে এবং ১ লাখ ১৮ হাজারের বেশি পদ স্থায়ী করেছে। চাকরিরত অবস্থায় দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করলে ২০ হাজার টাকার স্থলে ৫ লাখ টাকা এবং আহত হলে ২ লাখ টাকা অনুদান প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চিকিৎসাসেবা প্রদানের জন্য ১৫০ শয্যা বিশিষ্ট সরকারি কর্মচারী আধুনিক হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়েছে। বেতন, ভাতা, আবাসন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধিসহ দেশের পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসমূহকে আধুনিক ও দক্ষ করে গড়ে তোলার বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী রংপুরে নতুন বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বিভাগীয় শহর রংপুর, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা ও গাজীপুরকে সিটি করপোরেশন ঘোষণা করে সেসব করপোরেশনের নির্বাচন সম্পন্ন করা হয়েছে। ময়মনসিংহকে সিটি করপোরেশনে উন্নীত করা হয়েছে।
২০১২ সালের মধ্যে খাদ্যে আত্মনির্ভরশীলতা অর্জন করে। কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধি, কৃষি উৎপাদনে বৈচিত্র্য আনা, কৃষি গবেষণা এবং কৃষির আধুনিকায়নে অর্জিত হয়েছে যুগান্তকারী সাফল্য। সারের দাম কয়েক দফা হ্রাস, কার্ডের মাধ্যমে কৃষি উপকরণ বিতরণের ব্যবস্থা, মাত্র ১০ টাকায় কৃষকদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার সুযোগদান এবং বর্গাচাষি