নিজস্ব প্রতিবেদক:
১৯৭১ সাল। চারদিকে পরিস্থিতি টালমাটাল। উত্তাল দেশ। শুরু হলো পাকহানাদের অত্যাচার। আর তখনই নতুন বউ সেজে শ্বশুরবাড়ি এলেন বীরাঙ্গনা মমতাজ বেগম। রঙিন স্বপ্নে বিভোর সংসার সাজানো নিয়ে। ঠিক তখনই তার জীবনে নেমে আসে অমাবশ্যার কালো আঁধার। যে আঁধারে কেটে গেছে ৬০টি বছর।
মমতাজ বেগমের বাড়ি কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার কালির বাজার ইউনিয়নের আনন্দপুর গ্রামে। তার স্বামীর নাম মনু মিয়া। পাকসেনাদের নির্যাতনের শিকার হলেও মমতাজ বেগম বীরাঙ্গনা হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেয়েছেন স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে।
বীরাঙ্গনা হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয় কুমিল্লা জেলা প্রশাসন। সঙ্গে সাড়ে পাঁচ শতাংশ জমিও পেয়েছেন। এজন্য জেলা প্রশাসককে ধন্যবাদ জানিয়েছেন এ বীরাঙ্গনা। তবে মৃত্যুর আগে একটি ভালো ঘরে ঘুমাতে চান তিনি। বর্তমানে তিন ছেলে, ছেলের বউ, দুই মেয়ে ও স্বামীর সংসারে রয়েছে মাত্র একটি দোচালা ঘর।
মমতাজ বেগম বলেন, ১৯৭১ সালের বৈশাখ মাসের কোনো এক সকাল, তখন ৮টা কি ৯টা হবে। শাশুড়ি, স্বামী ও ভাসুরকে নাস্তা দিয়েছিলাম। সবার খাওয়া শেষ। আমিও নাস্তা করব। ঠিক এমন সময় খবর এলো গ্রামে পাকবাহিনী ঢুকছে। গ্রামের গরু-ছাগল নিয়ে যাচ্ছে। যুবকদের মারধর করছে আর মেয়েদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। এ কথা শোনার পর ‘বউ পালাও’ বলে আমার শাশুড়ি দৌড় দিলেন। এ বাড়িতে আমি বউ হয়ে আসছি মাত্র তিন মাস হতে চলল। ভালোভাবে সবার বাড়িঘর চিনি না। কোনদিকে যাব বুঝতে পারছি না।
নাস্তা আর খাওয়া হলো না। দিলাম একটি বাড়ির দিকে দৌড়। যেই মাত্র ওই বাড়ির উঠানে এলাম ওমা! এসেই দেখি ৭-৮ জন পাকসেনা আমার সামনে দাঁড়িয়ে। দৌড়ের কারণে আমি হাঁপাচ্ছিলাম। অমনি একজন আমার চুলের খোঁপা ধরে বিজাতীয় ভাষায় কী যেন বলল, বুঝলাম না। তারা একটি ঘরে নিয়ে আমাকে ব্যাপক নির্যাতন করল। বাপ-ভাই ডেকেও তাদের হাত থেকে রেহাই পাইনি।
এক সময় আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। জ্ঞান ফেরার পর দেখি চারদিকে অন্ধকার। চোখের পানি মুছতে মুছতে অজানা আশঙ্কা নিয়ে অনেক রাতে বাড়ি ফিরি। ভাবছি হয়তো আজই আমার সংসার জীবন শেষ। স্বামী আমাকে তাড়িয়ে দেবে। কিন্তু না। ঘরে ঢুকেই দেখি সবাই আমার জন্য অস্থির হয়ে আছে। আমি হাউমাউ করে কেঁদে বিছানায় ঢলে পড়লাম। এমন সময় আমার ভাসুর ফজর আলী, স্বামী মনু মিয়া ও শাশুড়িসহ সবাই আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, যা ঘটেছে তার বিচার আল্লাহ করবেন। এতে তোমার কোনো দোষ নেই। ভোরে আমরা সবাই বরুড়ায় চলে যাব। এ গ্রামে আর না।
স্ত্রী মমতাজ বেগমকে নিয়ে ভোরেই বাবার ফুফুর বাড়ি বরুড়া উপজেলার কাশেড্ডা গ্রামে চলে যান মনু মিয়া। যেন পাছে লোকে মমতাজ বেগমকে কিছু বলতে না পারে।
দেশ স্বাধীন হলো ১৬ ডিসেম্বর। নির্যাতিতা স্ত্রী মমতাজ বেগমকে নিয়ে ১৭ ডিসেম্বর সকালে নিজ বাড়ি আনন্দপুর ফিরলেন মনু মিয়া। মমতাজ বেগম লক্ষ্য করলেন, এতদিন যারা তাকে আদর করতেন, খোঁজ নিতেন, তারা এখন দূর থেকে তাকে আড় চোখে দেখেন। কেউবা তাকে সান্ত্বনার নামে খোঁচা দিয়ে কথা বলেন, তার চাপিয়ে রাখা কষ্টকে উসকে দেন। তবে সান্ত্বনা এ যে, স্বামীর ঘরের কেউই তাকে এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র দায়ী করেননি। বরং তার প্রতি সহানুভূতি দেখিয়েছেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার ঘটনাকে শাশুড়ি পাকসেনাদের প্রতি আল্লাহর গজব বলে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বিবেচনা করতেন বলে জানালেন মমতাজ।
মমতাজ বেগম আরো বলেন, ৭১ সালের এ দুঃখজনক ঘটনার কারণে কখনো বেশি মানুষের সামনে গিয়ে দাঁড়াইনি। স্বজনদের নানা অনুষ্ঠানে যাইনি। যদি কখনো তারা এ প্রসঙ্গে কোনো প্রশ্ন করেন। কত নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে ৪৪ বছর ধরে বেঁচে আছি তা কাউকে বোঝাতে পারব না। শুনেছি এ রকম নির্যাতিত মহিলাদের সরকারের পক্ষ থেকে বীরাঙ্গনা উপাধি দিয়ে নানা সাহায্য সহযোগিতা করছে। কিন্তু গত ৪৪ বছরে কেউ আমাদের খোঁজ নেয়নি। এবার জেলা প্রশাসন কুমিল্লায় অনুষ্ঠান করে আমার মতো আরো ১৪/১৫ জনকে সরকারি খাস জমি দিয়েছে।
মমতাজ বেগম বলেন, চার মেয়ে ও তিন ছেলের সংসার আমার। স্বামীরও বয়স হয়েছে। কাজ করতে পারছেন না। ছেলেরাও নিয়মিত কাজ পায় না। ছোট দোচালা ঘরটিই আমার একমাত্র সম্বল। আমার ছোট মেয়েটি আফজল খান গার্লস হাইস্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। টাকা-পয়সার জন্য তার লেখাপড়ার খরচও চালাতে পারি না। এতগুলো মানুষ এ ছোট ঘরটিতে থাকতে পারি না।
এ সমাজের কাছে, সরকারের কাছে আমার একটাই দাবি, দয়া করে আমাকে মাত্র একটি ঘর দিন। যেন মৃত্যুর আগে ঘরটির নিচে শান্তিতে ঘুমাতে পারি।
স্বামী মনু মিয়া বললেন, পাকিস্তানি সৈন্যরা আমার স্ত্রীকে নির্যাতন করায় যতটুকু কষ্ট পেয়েছি তার চেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছি এ দেশের মানুষদের আচরণে। যারা সুযোগ পেলেই এ প্রসঙ্গটি এনে আমাকে খোঁচা দিয়ে কথা বলতেন। আমাকে অনেকে কটু কথা বলতেন। আমি কোনোদিন তা মনে নেইনি। শুধু বলেছি আমার স্ত্রীর কোনো দোষ নেই। আমার স্ত্রী দেশের জন্য নির্যাতিত হয়েছেন এটাই আমার কাছে গর্বের বিষয়।
কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার ময়নামতি ইউনিয়নের হরিশপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বীরাঙ্গনা মমতাজ বেগম। বাবা-মায়ের সাত মেয়ের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। ১৪-১৫ বছরেই একই জেলার আদর্শ সদর উপজেলার কালিরবাজার ইউনিয়নের পশ্চিম আনন্দপুর গ্রামের মনু মিয়ার সঙ্গে তাকে দিয়ে দেন বাবা-মা। ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে মমতাজ-মনু মিয়ার দাম্পত্য জীবন শুরু হয়।