নিজস্ব প্রতিবেদক:
ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণ কক্ষে রবিবার রাত পৌনে ১টায় সংবাদ আসে, অজ্ঞাত এক যুবক পড়ে গেছে ৪০ ফুট গভীরে। এরপর তাকে উদ্ধারে পাঠানো হয় সূত্রাপুর রেসকিউ ইউনিট। সিনিয়র স্টেশন অফিসার সাইফুলের নেতৃত্বে সূত্রাপুরের ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে সাহায্য চায় ঢাকা হেড কোয়ার্টারের।
ডিএডি বজলুর রশিদের নেতৃত্বে স্টেশন অফিসার শহিদুল ইসলাম সুমনসহ ছয়জনের একটি উদ্ধারকারী দল রাত সোয়া ১টায় ছুটে যায় ঘটনাস্থলে। দেড় ঘণ্টার শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানের মধ্য দিয়ে ওই যুবককে উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া সেল থেকে সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানানো হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, সেদিনের ঘটনাস্থল ছিল পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়া ডিস্টিলারি রোডের (ধূপখোলা মাঠের পশ্চিম পাশে) একটি চারতলা বাড়ি। অ্যাম্বুলেন্সসহ সদর দপ্তরের রেসকিউ ইউনিটটি ঘটনাস্থলে পৌঁছে জানতে পারে, চারতলা ভবনের পাশে একটি ভয়েড স্পেস (ফাঁকা জায়গা) দিয়ে একজন যুবক নিচে পড়ে গেছেন।
উদ্ধারকারীরা ভবনের ছাদে গিয়ে ঘুঁটঘুঁটে অন্ধকার সুড়ঙ্গে লাইটের আলো ফেলে অস্পষ্টভাবে দেখতে পান পড়ে থাকা যুবককে। চারটি ভবনের সংযোগস্থলে তিন ফুট বাই দুই ফুটের অপ্রশস্ত জায়গাটি ওপর থেকে দেখলে মনে হয় মাটির নিচে চলে যাওয়া কোনো অন্ধকার সুড়ঙ্গ বা গর্ত। নিচে পড়ে থাকা ব্যক্তির তখনো চেতনা আছে। আহত অবস্থায় একটু গোঙরাচ্ছেন উদ্ধারকারীদের প্রশ্নে সাড়া দিতে পারছেন তিনি। উদ্ধারকারীদের কাছে নিশ্চিত হয় তার জীবিত থাকার বিষয়টি।
ঘটনাস্থল পর্যবেক্ষণ করে প্রয়োজনীয় তথ্য জানার পর উদ্ধার কৌশল নির্ধারণ করা হয়। শুরু হয় শ্বাসরুদ্ধকর উদ্ধার অভিযান। ডিএডি বজলুর রশিদের নির্দেশনায় স্টেশন অফিসার শহিদুল ইসলাম সুমন দায়িত্ব বণ্টন করেন উদ্ধারকারীদের। চৌকস উদ্ধারকর্মী মুক্তারকে শ্বাসপ্রশ্বাস গ্রহণের ব্যবস্থাসহ বিশেষ পোষাক পরিয়ে আর শরীরে হারনেস বেঁধে নামানো হয় অন্ধকার সুড়ঙ্গে। সঙ্গে দেয়া হয় অতিরিক্ত আরেকটি হারনেস।
ওপর থেকে হারনেসের প্রান্ত ধরে রাখেন অপর উদ্ধারকর্মীরা। দূরন্ত সাহস আর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অন্ধকারের ভয়কে জয় করে সহকর্মীদের সহায়তায় মুক্তার পৌঁছে যান সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তে পড়ে থাকা যুবকের কাছে। উদ্ধারকর্মীকে কাছে পেয়ে বিচলিত যুবক সাড়া দেন। তাকে অভয় বাণী শুনিয়ে দমকলকর্মী মুক্তার সঙ্গে নেয়া অতিরিক্ত হারনেসে সুরক্ষিত করে বেঁধে নেয় আহত ব্যক্তিকে। এবার ওপরে সংকেত পাঠান আহত ব্যক্তিকে টেনে তোলার।
চারতলা থেকে পড়ে যাওয়া এবং সুড়ঙ্গের নিচে আটকে থাকা ‘সালমান’ নামের ২৪ বছরের সেই যুবককে সবার সহযোগিতায় জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করে আনেন ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকারী দলের সদস্যরা।
আহত ব্যক্তির অবশ্য তখন করুণ অবস্থা। তিনি কিভাবে সেখানে পড়লেন, কেন সেখানে এসেছিলেন, পড়ার পর তার অবস্থা কী হয়েছিল, তিনি কেমন অনুভব করেছেন, মৃত্যু ভয় তাকে তাড়িত করেছে কি না- এসব তথ্য শোনার চেয়ে তার জীবন রক্ষার জন্য তাকে হাসপাতালে পাঠানোকেই অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করেন উদ্ধারকর্মীরা।
জীবন রক্ষার জন্য সঙ্গে থাকা ফায়ার সার্ভিসের অ্যাম্বুলেন্সে করে সালমানকে পৌঁছে দেয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
উদ্ধারকাজ সম্পন্ন করে রাত ২টা ২০ মিনিটে কর্মস্থলে ফিরে আসেন উদ্ধারকারীরা। রাতের নিস্তব্ধতা আর অন্ধকারে নিঝুম চারপাশ। কিন্তু সেই নিস্তব্ধ অন্ধকারেও উদ্ধারকর্মীদের চেহারায় লেগে থাকলো সাফল্যের অপার্থিব আলো, জীবন বাঁচানোর অবর্ণনীয় আত্মতৃপ্তি।
অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সাজ্জাদ হোসাইন, পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লে. কর্ণেল জিল্লুর রহমান উদ্ধার অভিযানের ভিডিও দেখে উদ্ধারকারীদের আন্তরিক অভিনন্দনে সিক্ত করেছেন।
উদ্ধারের পর সালমান ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের জানান, সালমান ওই এলাকার বাসিন্দা। তার কাছে অনেক লোক টাকা পান। ঘটনার দিন পাওনাদারদের ধাওয়া খেয়ে পালানোর সময় সেই ৪০ ফুট গভীরে পড়ে যান তিনি।