নিজস্ব প্রতিবেদক:
মেয়েকে স্কুলে আনা-নেয়ার সময় গড়ে উঠেছিল পরকীয়া সম্পর্ক। সেই থেকে পাঁচ বছর ধরে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত ছিলেন গৃহবধূ শাহনাজ হাসান ও শ্যামলী পরিবহন কাউন্টারের স্টাফ সজিব হাসান। অবশেষে নারী নেশাসহ নানা কারণে সজিবকে হত্যার পর মরদেহ পাঁচ টুকরো করেছেন পরকীয়া প্রেমিকা শাহনাজ। আর এই হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হলো সজিব-শাহনাজের পরকীয়া।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর ওয়ারীর স্বামীবাগের একটি ভবনের চারতলার ছোট কক্ষে চাঞ্চল্যকর সজিব হত্যাকাণ্ড ঘটে।
শাহনাজকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে পুলিশ জানায়, সজিবকে হত্যার কথা স্বীকার করেছেন শাহনাজ। তবে সজিব তার স্বামী নয়। শাহনাজের স্বামী একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। তাদের সংসারে দুই মেয়ে রয়েছে।
যেভাবে সজিব-শাহনাজের পরকীয়ার সূত্রপাত
পুলিশ বলছে, দুই মেয়ের মধ্যে এক মেয়েকে স্কুলে নেয়ার সময় পাঁচ বছর আগে শ্যামলী পরিবহনের কাউন্টারের স্টাফ সজিবের সঙ্গে পরিচয় হয় শাহনাজের। প্রথমে অল্প আলাপ হতো তাদের মধ্যে। এক পর্যায়ে আলাপ থেকে অনৈতিক সম্পর্কে জড়ান তারা।
স্বামীকে শাহনাজের ফাঁকি
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে শাহনাজ জানিয়েছেন, অনৈতিক সম্পর্কে জড়ানোর পর স্বামীবাগে বাসা ভাড়া নেন সজিব। আর সেই বাসা ভাড়া নেয়ার সময় শাহনাজকে স্ত্রী হিসেবে পরিচয় দেন পরকীয়া প্রেমিক। অনৈতিক সম্পর্কের জন্য স্বামীকে ফাঁকি দিতে থাকেন শাহনাজ। বুটিকসের কাজ শেখার কথা বলে বাসা থেকে নিয়মিত দিনের বেলায় বের হতেন তিনি। আর সন্ধ্যায় স্বামীর বাসায় ফিরতেন। স্বামীর সঙ্গেও শাহনাজের সুসম্পর্ক ছিল না। স্বামী-স্ত্রী দু’জন প্রায়ই ঝগড়া করতেন। পাঁচ বছর বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক রাখলেও শাহনাজের স্বামী তা টের পাননি।
সজিবের যেসব অপরাধের সন্ধান পান শাহনাজ
শাহনাজ পুলিশকে জানিয়েছেন, সজিব তার সঙ্গে সম্পর্কের কথা অন্যদের জানিয়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে প্রায়ই টাকা আদায় করতেন। এরপরও সজিব যেকোনো সময় তাদের সম্পর্ক কাউকে জানিয়ে দিতে পারে- এই ভয় থেকে তার সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখেন তিনি। এক পর্যায়ে আরো কয়েক নারীর সঙ্গে সজিবের অনৈতিক সম্পর্কের বিষয়টি টের পেয়ে যান শাহনাজ। এছাড়া শাহনাজের মেয়ের দিকে কুনজর দেন সজিব।
পরকীয়ার জন্য স্বামী-দুই সন্তানকে ছাড়েন শাহনাজ
শাহনাজ পরকীয়ায় এতটাই বুদ ছিলেন, তিনি স্বামী ও দুই মেয়ের ভালোবাসা ভুলে যান। গত সোমবার সজিবের বাসায় গিয়ে ওঠেন শাহনাজ পারভীন। তার খোঁজ না পেয়ে পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় জিডি করা হয়। পুলিশও জিডির তদন্ত শুরু করে। প্রযুক্তিগত ও অন্যান্য তথ্য বিশ্নেষণ করে পুলিশ বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টার দিকে শাহনাজের অবস্থান সজিবের বাসায় বলে নিশ্চিত হয়।
এরই মধ্যে সজিবকে হত্যার পর শাহনাজ তার স্বামী জসীমকেও ফোন করে জানান, খুব বিপদে আছেন। তাকে উদ্ধারের জন্য অনুরোধ করেন। জসীমও বিষয়টি পুলিশকে জানান।
হত্যার সূত্রপাত
ওয়ারী থানার ইন্সপেক্টর (অপারেশন) সাজ্জাদ রোমান বলেন, বৃহস্পতিবার সকালে ঘুম থেকে উঠে শাহনাজের স্বর্ণের গহনা বিক্রি করে দিতে বলেন সজিব। বাস কাউন্টারের কাজ ছেড়ে দিয়ে ওই টাকায় সজিব ব্যবসা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এতে আপত্তি শাহনাজ।
তাকে জানিয়ে দেন, তার কারণে স্বামীর সংসার ছেড়েছেন। তাই গহনা বিক্রি করবেন না। এ নিয়ে দুইজনের মধ্যে ঝগড়া হয়।
শাহনাজের দাবি, সজিব তাকে ছুরি দিয়ে মারতে উদ্যত হয়। এ সময় তিনি ছুরি কেড়ে নিয়ে সজিবের পেটে আঘাত করেন। এরপর এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করা হয়।
যে অবস্থায় মিলে সজিবের লাশ
পুলিশ যখন সজিবের ভাড়া বাসায় ঢুকে তখন বাড়ির মালিক ও প্রতিবেশীরা লাশ হতবিহ্বল হন। বাসার ছোট কক্ষে পাঁচ টুকরো মরদেহের সামনে শাহনাজকে ভাবলেশহীন অবস্থায় বসতে দেখা যায়।
পুলিশ জানায়, মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর সজিবের মরদেহের পাঁচটি টুকরো উদ্ধার করা হয়েছে। কনুই থেকে দুই হাত ও হাঁটু থেকে দুই পা কেটে বিচ্ছিন্ন করে মেঝেতে রাখা হয়।
শাহনাজ-সজিবের পরিচয় সম্পর্কে পুলিশ বলছে, শাহনাজ একজন গৃহিণী। চাঁদপুরে তার বাবার বাড়ি রয়েছে। আর সজিবের স্ত্রীর গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহে। গ্রামে থাকা মা-বাবা ও পরিবারের কারও সঙ্গে সজিবের সম্পর্ক ছিল না।
পুলিশের ওয়ারী বিভাগের সহকারী কমিশনার মো. হান্নানুল ইসলাম জানান, অনৈতিক সম্পর্কের জের ধরেই সজিব হত্যাকাণ্ড হয়েছে। স্বামীর বাসা থেকে বের হওয়ার পর শাহনাজকে সজিব নিজেই তার বাসায় নিয়ে আসেন। সে একজন বহুমুখী প্রতারকও।
ভাড়াটিয়ার তথ্য ফরমে সে নিজের স্ত্রীর নাম ‘মৌসুমী’ বলে জানিয়েছে। তবে এই নামে তার কোনো স্ত্রীর অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। আর লোকজন শাহনাজকেই সজিবের স্ত্রী হিসেবে জানতেন।
চরম ক্ষোভ থেকে সজিবকে হত্যার পর মরদেহকে পাঁচ টুকরো করা হয়েছে। এটা মানসিক বিকৃতির পরিচয়ও। শাহনাজের এক হাতে একটি আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে।
পুলিশের ওয়ারী অঞ্চলের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার কামরুল ইসলাম জানান, মরদেহের টুকরোগুলো স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মর্গে রাখা হয়েছে। রক্তমাখা ছুরিসহ শাহনাজ পারভীনকে আটক করে ওয়ারী থানায় নেয়া হয়েছে।
প্রাথমিকভাবে গ্রেফতার শাহনাজ পুলিশকে জানায় যে, তার সাথে সজীব হাসানের দীর্ঘ পাঁচ বছরের পরকীয়া সম্পর্ক। এই পরকীয়া সম্পর্কের জেরে তাদের মধ্যে অবাধ মেলামেশা এবং ওই বাসায় যাতায়াত ছিল। তবে এই সম্পর্কের জের ধরে সম্প্রতি সজিব হাসান তাকে ব্লাকমেইল করা শুরু করে।
ব্ল্যাকমেইলের অংশ হিসেবে সজিব হাসান শাহনাজ পারভীনের কাছে টাকা দাবি করে, নইলে অসামাজিক এ সম্পর্কের কথা সবাইকে বলে দেবে।
শাহনাজ জানান, দুজনের ঝগড়ার সময় সজীব তাকে ছুরি দিয়ে আঘাত করেন। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে ছুরিটি নিয়ে নেন শাহনাজ। এরপর তিনি সজিবকে ছুরি মারেন। এতে মারা যান সজিব।হত্যার পর রান্নাঘর থেকে বঁটি এনে সজীবের মরদেহ পাঁচ টুকরো করেন শাহনাজ।